স্বদেশ ডেস্ক:
মেসি-ম্যাজিকে মুগ্ধ গোটা বিশ্ব। জয়ধ্বনি উঠছে তার নামেই। আর ওই আলো থেকে একটু দূরে একেবারে ছাপোষা মানুষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর একজন। লিওনেল স্ক্যালোনি। তিতে, দেশঁ, এনরিকে, ভ্যান গলের মতো জৌলুস নেই তার। আলোচনাও তাকে নিয়ে তুলনায় কম। কিন্তু তাতে কী! মগজাস্ত্রের নিখুঁত নিশানায় ঘায়েল করছেন একের পর এক প্রতিপক্ষকে। মেসি-আলোয় ঝলমলে পৃথিবীতে তাই কিছুতেই সরিয়ে রাখা যায় না স্ক্যালোনির গল্প।
এই বিশ্বকাপের নক্ষত্র একজনই। লিওনেল। মেসি বংশের। তবে, এই কুল ছাপিয়ে আছেন আরেক লিওনেল। ছাপোষা লিওনেল, সাদামাটা লিওনেল, সাইডলাইনের ধারে শান্ত হয়ে বসে থাকা ছিপছিপে সেই লিওনেল অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছেন একই নামের হাজার হাজার ওয়াটের আলোয়। মেসির বিশ্বকাপের এই আলো ছড়ানোর পিছনে নিঃশব্দে জ্বালানির জোগান দিয়েছেন যিনি, তিনি আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি।
এখন ভাবলে একটু অদ্ভুতই লাগে। স্ক্যালোনি যখন আর্জেন্টিনার দায়িত্ব নিলেন, তখন তো এসব চিত্রনাট্য যে কোনো দিন লেখা হতে পারে, এ কারো দূরকল্পনাতেও আসেনি। আসার মতো পরিস্থিতিও ছিল না৷ ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হট সিটে হোর্খে সাম্পাওলি৷ দুঁদে ম্যানেজার। যিনি চিলিকে কোচিং করিয়ে কোপা জিতিয়েছেন, বিশ্বকাপে চমকে দিয়েছে চিলি। সেই সাম্পাওলির অ্যানিমেটেড হয়ে সাইডলাইনের ধারে ঘুরে বেড়ানোর সময় বেঞ্চের এক কোণে বসে থাকতেন তার এই সহকারী ছেলেটি। স্ক্যালোনি। ভাগ্যের কী পরিহাস! চূড়ান্ত সফল কোচ সাম্পাওলি কিন্তু আর্জেন্টিনাতে একেবারে ফ্লপ। গ্রুপ স্টেজ বিদায় কোনোমতে ঠেকিয়ে, সুপার সিক্সটিনেই বাদ। সাম্পাওলিকে সরে যেতে হলো। আর্জেন্টিনার রাস্তাজুড়ে ক্ষোভ, উত্তপ্ত পরিস্থিতি। এর মাঝে আর্জেন্টাইন ফুটবল আসোসিয়েশন স্পষ্ট করে দিলো যে এই মুহূর্তে মোটা অঙ্কের মাইনে দিয়ে কোচ আনার বাজেট তাদের নেই। ইন্টেরিম বা অন্তর্বর্তী কোচ হিসেবে তরুণ স্ক্যালোনি কিছু দিন কাজ করবেন, তারপর নতুন কাউকে আনা হবে। সেই শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়।
আসলে এত কম পারিশ্রমিকে পেকেরম্যানের দলের এই আনকোরা খেলোয়াড়টি দেশের ফুটবলের কোচিং করানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তা অভাবনীয়।
স্ক্যালোনির হাত ধরে চলে যাওয়া যাক ২০১৯ কোপা আমেরিকায়। আর্জেন্টিনা শুরু করল ছন্নছাড়াভাবে, স্ক্যালোনির কোচিং একেবারে খাদের কিনারে। অথচ, টুর্নামেন্টে ম্যাচ গড়াতেই আর্জেন্টিনা বদলাল, আর্জেন্টিনা দুরন্ত খেলেও সেমিফাইনালে ছিটকে গেল ব্রাজিলের কাছে হেরে। স্ক্যালোনি ওই মুহূর্ত থেকে বুঝেছিলেন, দলকে তৈরি করতে হবে, এ দলের ক্ষমতা আছে। ২০১৮-এর দলে আমূল বদল আনলেন, স্পেনে দীর্ঘদিন খেলা এবং কোচিং শেখার সুবাদে স্ক্যালোনি পালসটা বুঝে নিলেন। এরপর শুরু হলো এক অবিশ্বাস্য জার্নি। ২০২১ কোপা আমেরিকাতে আর্জেন্টিনা খুঁড়িয়ে শুরু করেও, ম্যাচ জিতল। খুব দৃষ্টিনন্দন ফুটবল না খেলেও কিভাবে কার্যকরী ফুটবল খেলতে হয়, কিভাবে প্রতিপক্ষ বুঝে কখনো তিন ব্যাক কখনো চার ব্যাকে যেতে হয়, কিভাবে মিড ওভারলোড করতে হয় তা ইনজেক্ট করলেন দলে। ফাইনালে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রাজিল ধরাশায়ী, সৌজন্যে স্ক্যালোনির নাগপাশ। তারপর ইতালিকে হারিয়ে ফাইনালিস্মা। বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই তাই আর্জেন্টিনাকে নিয়ে হইচই। অথচ ফ্লিক, সাউথগেট, দেশঁদের মতো কোচেদের থেকে প্রায় অর্ধেক স্যালারিতে (২.২ মিলিয়ন) আজও কাজ করে যাচ্ছেন স্ক্যালোনি।
বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ সৌদি আরবের হারের পর স্ক্যালোনির চোয়াল শক্ত। বললেন, ‘আমরা কিছু ভুল করেছি। আমাদের ওপর একটু ভরসা রাখুন। আমরা শুধরে নেব…’; শুধরোলেন সে ভুল৷ আর আর্জেন্টিনা ট্যাকটিকাল ব্রিলিয়ান্সে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেল ফাইনালে। কোয়ার্টার ফাইনালে লুই ভ্যান হালের মতো দুঁদে কোচের তিন ব্যাক সিস্টেমের পালটা হিসেবে স্ক্যালোনি যেভাবে লিসান্দ্রোকে নামিয়ে তিন ব্যাকে গেলেন, যেভাবে মলিনাকে ওপরে তুলে গোলের রাস্তা পরিস্কার করলেন তা চমকে দিলো ফুটবল বিশেষজ্ঞদের। ‘স্ক্যালোনিজম’-কথাটা প্লেয়াররা মজা করে বলে ড্রেসিংরুমে। আর স্ক্যালোনিজমের সর্বোত্তম প্রকাশ ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ। জলাটকো দালিচের মতো বিদগ্ধ কোচকেও ট্যাকটিক্সে মাত করলেন স্ক্যালোনি!
পরিসংখ্যান? ৫৫ ম্যাচ খেলে ৩৯টা জয়। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড – সবই তিন বছরে এসেছে স্ক্যালোনির দখলে। এ বিশ্বকাপ লিওনেল মেসির আলোয় ঝলমলে। তবে ওই যে আর্জেন্টিনার বহুকাঙ্ক্ষিত ট্রফিটি পেতে গেলে সেদিন ম্যারাডোনার পাশে দরকার ছিল কার্লোস বিলার্দোকে, আর এখন মেসির দরকার লিওনেল স্ক্যালোনি আর তার মগজাস্ত্রকেই।
সূত্র : সংবাদ প্রতিদিন